ঢাকা,শুক্রবার, ৩ মে ২০২৪

জাফর আলমের পতন দেখলো চকরিয়া-পেকুয়াবাসী

মিজবাউল হক ::  জাফর আলম। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য প্রার্থী। বর্তমান সাংসদও তিনি। ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে নানাভাবে আলোচিত-সমালোচিত ছিলেন জাফর আলম। বিতর্কিতও কম হননি তিনি। এবারের নির্বাচনে জাফর আলমকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহিম। একজন জাফর আলমের যেভাবে উত্থান দেখেছে সেভাবেই পতন দেখলো চকরিয়া-পেকুয়াবাসী।

জানা যায়, জাফর আলম একাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এই জয়ের পর থেকে টানা পাঁচবছর ধরাকে সরা জ্ঞান করতেন তিনি। তার অঙ্গুলের ইশারায় চকরিয়া-পেকুয়াকে শাসন শোষণ করেছেন। এই আসনে নিজের বলয় তৈরী করে যা ইচ্ছা তাই করেছেন। কেউই অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেও হয়রানীর মুখে পড়তে হয়েছে তাকে। এসময়ে স্থাবর অস্থাবর অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন স্বনামে বেনামে।

যে কোন নির্বাচনে প্রতিদ্ব›দ্বীতার সাহস দেখাতেন তিনি। ২০০৪ সালে চকরিয়া পৌরসভার প্রভাবশালী চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হাকিম দুলালকে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। এরপর থেকে নানাভাবে আলোচিত হতে থাকেন জাফর আলম। আন্দোলন সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকাও রাখার কারণে নেতাকর্মীদের কাছে আসার সুযোগ তৈরী হয় জাফর আলমের। সেই সুযোগ লুফে নেন জাফর আলম। পরবর্তীতে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন জাফর আলম। এরপর ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাফর আলম এমপি নির্বাচিত হন। এভাবে একেরপর এক রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে অভাবনীয় উত্থান ঘটে জাফর আলমের।

ফলে কাউকে তোয়াক্কা করতেননা তিনি। এমন কি তার ইচ্ছার বাস্তবায়ন না হলে আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়েও প্রকাশ্যে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ও গালিগালাজ করতেন। তাই তার সাথে টানা স্থায়ী সম্পর্ক টিকতোনা কারও।

জাফর আলম এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় আওয়ামী লীগ বাদ দিয়ে গড়ে তুলেন “জাফর লীগ”। গত পাঁচটি বছর এই জাফর লীগ দিয়ে চকরিয়া-পেকুয়ায় আওয়ামীলীগ নিধন, সাধারণ মানুষের জমি দখল, চিংড়িঘের দখল ও সরকারি জমি দখল খুন খারাবিসহ নানা অপকর্ম সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় তার কাছে। তার ভাতিজা জিয়াবুল ও ভাগিনা মিজানের নেতৃত্বে শতাধিক ক্যাডার নিয়ে বাহিনী গড়ে তুলেন। এই বাহিনী দিয়ে ৫টি বছর খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, চিংড়িঘের দখল ও সাধারণ মানুষের জমিজমা দখলের অপরাধ করেছেন। চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার চিংড়িজোনের চাষীরা থাকতেন আতঙ্কে। তার বাহিনীকে প্রতি মৎস্য জো’য়ে মাছ ও চাঁদা না দিলে দখল হয়ে যেতো চিংড়ি ঘের। এভাবে চাষীরা চাঁদা দিয়ে মাছ চাষ করেছেন। এ বাহিনীর অপকের্মর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিলো “গরুচুরি”। এই বাহিনীর হাতে নিরাপদ ছিলো না খামারী ও গৃহস্থালীরা।

এমপি জাফর আলমের ডান হাত হিসেবে পরিচিত বৃহত্তম চট্টগ্রামের আলোচিত গরুচোর সিন্ডিকেটের প্রধান সাহারবিল ইউপি চেয়ারমান নবী হোছাইন। নবী হোছাইনের নেতৃত্বে এ অঞ্চলে গরু চুরি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে উঠে। তাকে দিয়ে উপকূলী এলাকায় চিংড়িঘেরে ডাকাতি ও গরুচুরি করানো হতো বলে অভিযোগ রয়েছে জাফর আলমের বিরুদ্ধে। নবী হোছাইন একাধিকবার গ্রেফতার বা তার বিরুদ্ধে মামলা হলেও এমপি জাফর আলমের সহযোগিতায় পার পেয়ে যেতো। জাফর আলমের অত্যাচার থেকে আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতারাও রেহায় পায়নি।

তার ক্যাডার জিয়াবুল, মিজান ও রুবেলের হাতে হামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মাতামুহুরী থানা আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাাদক মহসিন বাবুল, সাংগঠনিক সম্পাদক ইকবাল দরবেশী ও উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মারুফ হোসেন। তারা এই বাহিনীর হামলা ও নিযার্তনের শিকার হন।

৫টি বছর চকরিয়া, পেকুয়া, মাতামুহুরী থানা ও চকরিয়া পৌরসভা আওয়ামী লীগ থেকে দীর্ঘদিন ধরে পরিক্ষিত ও মুজিব আদর্শের ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে গড়ে তুলেন জাফর লীগ। এই জাফর লীগ দিয়ে দল পরিচালনা হতো। তার সিদ্ধান্তের বাইরে গেলেই মৌখিক নির্দেশে কমিটি ভেঙ্গে দেয়া হতো। সেখানে জাফর আলমের অনুসারী বা স্বজনদের পদে বসিয়ে দল চালিয়ে আসছেন। এভাবে একেরপরএক অপরাধের কারণে মুখ ফিরিয়ে নেন ত্যাগী আওয়ামীলীগ, অঙ্গ ও সহযোগি সংগঠনের নেতাকর্মীসহ চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার জনগণ।

ক্ষমতার দাম্ভিকতায় এসবের কিছুই পাত্তা দেননি তিনি। নেতাকর্মীরা কোন অভিযোগ নিয়ে গেলে টাকা ছাড়া কথা বলতেন না জাফর আলম। সাথে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে তার পুত্র তানভির আহমদ সিদ্দিকী তুহিনও। এমপি পুত্র হওয়ায় আলাদা বাহিনী গড়ে তুলে সে। স্বাধীন মঞ্চ নামে একটি সংগঠন করে। সেই সংগঠনে জামায়াত শিবির, ছাত্রদল ও কিছু অছাত্র দিয়ে এই সংগঠটনির কার্যক্রম চালাতো সে। তার পিতার মতের বিরুদ্ধে গেলে এই সংগঠনের সদস্য দিয়ে হয়রানি করা হতো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার চালাতেন তুহিন। এক ধরণের জিম্মী করে জাফর আলমের পক্ষে কাজ করার জন্য বাধ্য করতেন। সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে ফেসবুকে সমালোচনা করা যেন নিয়মিত ব্যাপার ছিলো। তার অপকর্মে সহযোগিতা করতেন জাফর আলম। পুত্র তুহিনের এসব কাজ আরও উৎসাহ দিতেন। এরফলে তুহিন দিন দিন আরও ব্যাপারো হয়ে উঠেন। এভাবে সাধারণ জনগণ মুখ ফিরিয়ে নেয় জাফর আলমের কাছ থেকে।

এবারের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন থেকে ছিড়কে পড়েন তিনি। নানা বির্তকিত কর্মকান্ডে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চক্ষুসুল হয়ে উঠেন তিনি। এরইমধ্যে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিলেও তা না মেনে জাফর স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্ব›দ্বীতা করেন।

সর্বশেষ রবিবার বিপুল ভোটের ব্যবধানে জাফর আলমকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক। হাতঘড়ির প্রার্থী সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহিম পেয়েছেন ৮১৯৫৫ ভোট ও তার প্রতিদ্ব›দ্বী ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী জাফর আলম পেয়েছেন ৫২৮৯৬ ভোট। ভোটের ব্যবধান ২৯০৫৯ ভোট। আর এভাবে জাফর আলমের পতনও দেখলো চকরিয়া-পেকুয়ার জনগণ। দৈনিক কক্সবাজার।

পাঠকের মতামত: